প্রশ্নঃ ৩৮৪. হানাফী মাযহাব মতে কোরবানী ওয়াজিব। আর আহলে হাদিসদের মতই সুন্নত। কোনটা সঠিক?
কুরবানির বিধান
কুরবানি ওয়াজিব না সুন্নাতে মুয়াক্কাদা— এ নিয়ে ফকিহগণের মাঝে মতপার্থক্য প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান।
১. ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে মত পোষণকারী ফকিহগণ:
ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম রাবিয়াতুর রায় (রহ.), ইমাম আওযাঈ (রহ.), ইমাম লাইস বিন সা'দ মিশারি (রহ.), ইমাম সুফিয়ান ছাওরী (রহ.), ইব্রাহিম নাখয়ী (রহ.), ইমাম মালেক (রহ.)-এর একটি মত।
তাবেয়ীনদের মধ্যে ইমাম মুজাহিদ (রহ.), ইমাম মাকহুল (রহ.) এবং ইমাম শা'বী (রহ.)।
২. সুন্নাত হওয়ার পক্ষে মত পোষণকারী ফকিহগণ:
ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ইমাম আহমদ (রহ.) এবং ইমাম মালেক (রহ.)-এর অপর একটি বর্ণনা।
বহু তাবেয়ী ও ফকিহ।
উভয় পক্ষই কুরআন-সুন্নাহর আলোকে নিজ নিজ মতের পক্ষে দলিল পেশ করেছেন।
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে মূল দলিলসমূহ:
প্রথম দলিল: সূরা কাউসার (১০৮:২)
আয়াত: "فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ" (অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন।)
ব্যাখ্যা: এই আয়াতে 'নাহর' (কুরবানি) করার নির্দেশ এসেছে, যেমন 'সালাত' আদায়ের নির্দেশ এসেছে। বহু সালাফ ও মুফাসসিরের মতে, 'নাহর' দ্বারা কুরবানি উদ্দেশ্য। এই নির্দেশসূচক শব্দ দ্বারা কুরবানি ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। হযরত আলী (রা.) ও ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত 'বুকের উপর হাত রাখা' বিষয়ক ব্যাখ্যাগুলো দুর্বল ও জাল বলে অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও মুফাসসির প্রত্যাখ্যান করেছেন।
দ্বিতীয় দলিল: আবু হুরায়রা (রা.)-এর হাদিস
হাদিস: "যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ সে কুরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।"
ব্যাখ্যা: ইমাম ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেন, এটি কঠিন ধমকি, যা ওয়াজিব তরক করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। হাদিসটি সহীহ এবং এর সনদ গ্রহণযোগ্য।
তৃতীয় দলিল: জাবের (রা.)-এর হাদিস (পুনরায় কুরবানির নির্দেশ)
হাদিস: রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনাতে ঈদের নামায পড়ানোর পর যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি করে ফেলেছিলেন, তাদের পুনরায় কুরবানি করার নির্দেশ দিলেন।
রেফারেন্স: সহীহ মুসলিম-১৯৬৪।
ব্যাখ্যা: যদি কুরবানি ওয়াজিব না হতো, তাহলে রাসূল (সা.) পুনরায় কুরবানি করার নির্দেশ দিতেন না।
চতুর্থ দলিল: জুনদুব আল বাজালী (রা.)-এর হাদিস (পুনরায় কুরবানির নির্দেশ)
হাদিস: রাসূল (সা.) বলেন, "যারা নামাযের পূর্বে কুরবানি দিয়েছো তারা তার পরিবর্তে অবশ্যই পুনরায় কুরবানি করো। আর যারা তখন কুরবানি করোনি তারা আল্লাহর নামে কুরবানি করো।"
রেফারেন্স: সহীহ মুসলিম-১৯৬০।
ব্যাখ্যা: এই নির্দেশমূলক বাণীও কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ।
হাদিস: আবু বুরদা (রা.) ভুল সময়ে কুরবানি করায় রাসূল (সা.) তাকে পুনরায় কুরবানি করতে বললেন, এমনকি তিনি একটি ছোট বকরি দিয়ে হলেও তা করার নির্দেশ দিলেন (যদিও এটি শুধু আবু বুরদা (রা.)-এর জন্য বিশেষ অনুমতি ছিল)।
হাদিস: রাসূল (সা.) বলেন, "হে মানুষ সকল! প্রত্যেক পরিবারের কর্তার উপর প্রতি বছর কুরবানি করা আবশ্যক এবং আতিরাও।"
রেফারেন্স: আবু দাউদ-২৭৮৮, তিরমিজি-১৫১৮, নাসাঈ-৪২২৪, ইবনে মাজাহ-৩১৩৫। (হাদিসটি হাসান)।
ব্যাখ্যা: 'আতিরা' রহিত হলেও 'কুরবানি'র বিধান বহাল। 'আলা' (على) শব্দটি দ্বারা এখানে বাধ্যতামূলক অর্থ বোঝানো হয়েছে।
ওয়াজিব অমান্যকারীদের দলিলের খণ্ডন:
প্রথম দলিল: উম্মে সালমা (রা.)-এর হাদিস ('ইচ্ছা করবে' শব্দ)
হাদিস: "যখন যিলহজের প্রথম দশদিনের আগমন ঘটবে, তখন তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানি করার ইচ্ছা করবে তারা চুল-নখ ইত্যাদি কাটবে না।" (সহীহ মুসলিম-১৯৭৭)
খণ্ডন:
সকল শরয়ী বিধান পালনের জন্য 'ইচ্ছা' বা 'নিয়ত' শর্ত। এই হাদিসে 'ইচ্ছা' শব্দটি শুধুমাত্র সামর্থ্যবানদের জন্য প্রযোজ্য।
দ্বিতীয় দলিল: ইবনে আব্বাস (রা.) ও আনাস (রা.)-এর হাদিস (আমার উপর ফরয, তোমাদের জন্য নফল)
হাদিস: "তিনটি কাজ আমার উপর ফরয আর তোমাদের জন্য নফল। (১) কুরবানি (২) সালাতুল বিতর (৩) সালাতুত দোহা।" (বাইহাকি-১৯০৩০, মুসনাদে আহমদ-২০৫০)
খণ্ডন:
হাদিসের দুর্বলতা: এই হাদিসটি অত্যন্ত দুর্বল, এমনকি জাল (মাওজু') বলে অনেক মুহাদ্দিস (যেমন ইবনুল জাওযি, নাসির উদ্দিন আলবানী, শুয়াইব আল-আরনাউত) অভিমত দিয়েছেন। এর বর্ণনাকারীদের মধ্যে জাল হাদিস বর্ণনাকারী ও শিয়া রাবী রয়েছেন। দুর্বল হাদিস দ্বারা শরীয়তের বিধান প্রমাণ করা যায় না।
ব্যাখ্যা (যদি সহীহ ধরা হয়): আল্লামা কাসানি (রহ.) বলেন, যদি এটি সহীহও হয়, তবে এর অর্থ হলো, কুরবানি নবীজির জন্য ফরজ ছিল, আর উম্মতের জন্য ফরজ নয়, তবে ওয়াজিব হতে পারে। কারণ ফরজ ও ওয়াজিবের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
উপসংহার:
উপরে উল্লেখিত কুরআন ও সহীহ হাদিসের মজবুত দলিল এবং মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ ফকিহ ও মুহাদ্দিসের ব্যাখ্যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব ও বাধ্যতামূলক। যারা একে ঐচ্ছিক বা শুধু সুন্নাত বলেন, তাদের দলিলগুলো হয় দুর্বল, নয়তো তাদের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।