তালাক কী এবং কেন?
তালাক আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ হলো ছেড়ে দেওয়া, বন্ধনমুক্ত করা, বিচ্ছেদ ঘটানো। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, স্বামী কর্তৃক বিশেষ শব্দের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে তালাক বলে।
ইসলামে তালাকের অবস্থান: ইসলাম বিবাহকে একটি পবিত্র বন্ধন এবং আল্লাহর একটি নিদর্শন হিসেবে দেখে। তাই সামান্য কারণে এই বন্ধন ছিন্ন করাকে ইসলাম পছন্দ করে না। হাদীসে এসেছে, "আল্লাহর কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ হলো তালাক।" (আবু দাউদ: ২১৭৮)। তবে, যখন দাম্পত্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়, তখনই তালাকের অনুমতি দেওয়া হয়েছে—যাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই অন্যায়, জুলুম ও অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে।
তালাক দেওয়ার শরীয়তসম্মত পদ্ধতি (সুন্নাহসম্মত তালাক)
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে তালাকে আহসান বা তালাকে হাসান। এর উদ্দেশ্য হলো সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য সুযোগ রাখা এবং স্ত্রীর জন্য ইদ্দত পালনের সুযোগ দেওয়া।
১. তালাকে আহসান (সর্বোত্তম পদ্ধতি): * স্ত্রী যখন মাসিকমুক্ত (পবিত্র) অবস্থায় থাকবে এবং সে পবিত্র অবস্থায় তার সাথে সহবাস করা হয়নি, তখন তাকে স্বামী এক তালাক (রজ'ঈ) দেবে। * তালাকের পর স্বামী-স্ত্রী একই বাড়িতে ইদ্দত পালন করবে, তবে তাদের মেলামেশা (সহবাস) থেকে বিরত থাকবে। * এই তালাক দেওয়ার পর স্ত্রী তার ইদ্দত (তিন মাসিক চক্র বা গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত) পূর্ণ করবে। * ইদ্দত চলাকালীন স্বামী চাইলে যেকোনো সময় স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে (রুজু' করতে) পারবে, এমনকি মুখে 'ফিরিয়ে নিলাম' বললেও হবে, বা সহবাস করলেও রুজু হয়ে যাবে। এর জন্য নতুন করে বিয়ে বা মহরের প্রয়োজন নেই। * যদি ইদ্দত শেষ হয়ে যায় এবং স্বামী রুজু' না করে, তাহলে তালাকটি 'তালাকে বায়েন' (বৈনুনাতুস সুগরা) হয়ে যাবে। তখন নতুন করে বিয়ে (নিকাহ) ও নতুন মহর নির্ধারণ করে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে। * এই পদ্ধতিতে স্বামী মাত্র একটি তালাক ব্যবহার করায় ভবিষ্যতে আরও দুটি তালাক দেওয়ার সুযোগ তার হাতে থাকে।
২. তালাকে হাসান (উত্তম পদ্ধতি): * স্বামী স্ত্রীকে তার পবিত্র অবস্থায় (যখন সহবাস হয়নি) এক তালাক দেবে। * এরপর পরবর্তী মাসিক শেষে আবার যখন পবিত্র হবে, সেই পবিত্র অবস্থায় দ্বিতীয় তালাক দেবে। * এরপর তৃতীয়বার মাসিক শেষ হয়ে যখন পবিত্র হবে, তখন তৃতীয় তালাক দেবে। * অর্থাৎ, পরপর তিনটি তুহুর (পবিত্রতার সময়) এর মধ্যে তিনটি ভিন্ন সময়ে একটি করে মোট তিন তালাক দেওয়া। এই পদ্ধতিতেও স্বামী প্রতিটি তালাকের পর ইদ্দত চলাকালীন রুজু' করতে পারে, যদি তিন তালাক পূর্ণ না হয়।
যেসব পদ্ধতিতে তালাক দেওয়া শরীয়তে নিন্দনীয় (তালাকে বিদ'আত)
বর্তমান সমাজে তালাকের যে ভুল প্রয়োগ বেশি দেখা যায়, তা হলো:
১. একসাথে তিন তালাক: একই মজলিসে বা একই শব্দে ("তোমাকে তিন তালাক দিলাম") তিন তালাক দেওয়া। যদিও ফিকহের অধিকাংশ আলেমের মতে এটি তিন তালাক হিসেবেই কার্যকর হয় (যদি স্বামী সুস্থ মস্তিষ্ক ও প্রাপ্তবয়স্ক হয়), এটি শরীয়তে মারাত্মক গুনাহ ও বিদ'আত হিসেবে গণ্য। * কুফল: এভাবে তিন তালাক দিলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়ে যায়। তারা আর কখনোই (হিলা বিয়ে ব্যতীত) একে অপরের জন্য হালাল হয় না। এটি এমন একটি ঘৃণিত কাজ যে, এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী আজীবনের জন্য অপরিচিত হয়ে যায়, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করে এবং সেই স্বামীর সাথে তার সহবাস হয়, অতঃপর সেই স্বামী তাকে তালাক দেয় অথবা মারা যায় এবং স্ত্রী ইদ্দত পালন করে। এরপরই কেবল প্রথম স্বামীর জন্য তাকে নতুন করে বিয়ে করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে (যা 'হিলা বিয়ে'র উদ্দেশ্য নিয়ে করা হারাম)।
২. ঋতু অবস্থায় তালাক: স্ত্রী যখন মাসিক অবস্থায় থাকে, তখন তালাক দেওয়াও বিদ'আত এবং অত্যন্ত গুনাহের কাজ। সূরা তালাকের প্রথম আয়াতে আল্লাহ তা'আলা ইদ্দত অনুসারে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যা পবিত্র অবস্থায় হয়।
৩. সহবাসের পর পবিত্র অবস্থায় তালাক: পবিত্র অবস্থায় সহবাস করার পর সেই তুহুরে তালাক দেওয়াও অপছন্দনীয়। কারণ, এই সহবাসের ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে, যা ইদ্দত নির্ধারণে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তালাকের প্রভাব ও ইদ্দত
তালাক কখন কার্যকর হয়: স্বামী যদি সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হয় এবং স্পষ্ট শব্দে তালাক দেয়, তাহলে তালাক তখনই কার্যকর হয়। বাংলাদেশের আইনে তালাক নোটিশের মাধ্যমে সম্পন্ন হলেও, শরীয়তের দৃষ্টিতে তালাক উচ্চারণ করার সাথে সাথেই কার্যকর হতে পারে। তালাকের নিয়ত ছাড়া ভয় দেখানোর জন্য বলা কথা কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর নাও হতে পারে, তবে এ বিষয়ে একজন বিজ্ঞ আলেমের সাথে পরামর্শ করা জরুরি।
ইদ্দত: তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। একে ইদ্দত বলে।
মাসিক হয় এমন নারীর জন্য: তিন পূর্ণ মাসিক (হায়েয) অতিক্রম করা পর্যন্ত। (সূরা বাকারা: ২/২২৮)
মাসিক হয় না এমন নারীর জন্য (যেমন অপ্রাপ্তবয়স্ক বা বৃদ্ধা): তিন মাস।
গর্ভবতী নারীর জন্য: সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত। (সূরা তালাক: ৬৫/৪)
ইদ্দতকালীন সময়ে স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
বর্তমান সমাজে তালাকের ভুল প্রয়োগ ও তার কুফল
বর্তমান সমাজে তালাকের মাসআলা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বহু মানুষ মারাত্মক ভুল করে থাকে:
একসাথে তিন তালাক: এটিই সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে, যেখানে স্বামী রাগের মাথায় বা অজ্ঞতাবশত একসাথে তিন তালাক দিয়ে দেয়, যা তাদের সম্পর্ককে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরবর্তীতে তারা শরীয়ত অনুযায়ী আর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে পারে না, কিন্তু না জেনে বা ভুল ফতোয়ার কারণে একই সাথে বসবাস করে।
হিলা বিয়ে: একসাথে তিন তালাক দেওয়ার পর সম্পর্ক হালাল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে 'হিলা বিয়ে'র আশ্রয় নেওয়া হয়, যা ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম ও অভিশপ্ত।
ইদ্দতের জ্ঞান না থাকা: ইদ্দত সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তালাকপ্রাপ্তা নারী দ্রুত অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যা হারাম।
স্ত্রীকে বঞ্চিত করা: তালাকের পর স্ত্রীর মহর বা ভরণ-পোষণ না দেওয়া, যা শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন।
সমাধান ও করণীয়
মানুষকে জিনা থেকে রক্ষা করতে এবং সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হলে তালাকের বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি:
সঠিক জ্ঞান অর্জন: প্রতিটি মুসলিম দম্পতির উচিত বিবাহের পূর্বে ও পরে তালাক সংক্রান্ত শরীয়তের বিধানগুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া।
আলেমদের ভূমিকা: আলেম-উলামাদের উচিত খোতবা, ওয়াজ-নসিহত এবং অন্যান্য মাধ্যমে তালাকের সঠিক পদ্ধতি ও এর ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
পরিবার ও সমাজ: পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে এই বিষয়ে আলোচনা করা এবং সঠিক পরামর্শ দেওয়া।
ধৈর্য ও সহনশীলতা: দাম্পত্য জীবনে ছোটখাটো সমস্যায় দ্রুত তালাকের সিদ্ধান্ত না নিয়ে ধৈর্য ধারণ করা এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "আল্লাহর কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে তালাক সবচেয়ে ঘৃণিত।"
বিবাহ একটি মজবুত বন্ধন। এটিকে টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। যখন আর কোনো পথ খোলা না থাকে, কেবল তখনই শরীয়তসম্মত উপায়ে তালাক দেওয়া যেতে পারে, যাতে পরবর্তীতে অনুশোচনা বা হারাম কাজের দিকে ধাবিত হতে না হয়।
কিতাবুত তালাক, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ও শামী ।