সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত মরুর দেশের প্রাণী সান্ডা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেশগুলোতে বসবাসকারী বেশ কিছু বাঙালি তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও দিচ্ছেন। সেখানে দেখা যায় তারা তাদের কফিলের জন্য সান্ডা ধরছে। এ সময় কেউ কেউ শেয়ার করছেন বিভিন্ন ছবি। যা নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তবে এখানেই শেষ নয়, বানানো হচ্ছে নানা মিম।
এদিকে সান্ডা খাওয়া নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে প্রায়ই জিজ্ঞাসা দেখা যায় – এটি কি ইসলামে হারাম নাকি হালাল? কুরআন ও হাদিসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে আলেমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু কুরআন মাজিদে সরাসরি সান্ডা খাওয়ার ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই, তাই এর বিধান নির্ধারণে হাদিস ও ফিকহি নীতি অনুসরণ করা হয়।
সান্ডা কি?
‘দব’ মূলত আরবের মরুভূমির একটি প্রাণী । সুতরাং আরবী অভিধান থেকে আমরা ‘দব’ এর পরিচয় জেনে নিতে পারি।
প্রসিদ্ধ আরবী অভিধান ‘আল মুজামুল ওয়াসীত’-এ ‘দব’ এর পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে-
الضب حيوان من جنس الزواحف من رتبة العظاء، غليظ الجسم خشنة، و له ذنب عريض حرش أعقد، يكثر في صحراء الأقطار العربية.
‘দব’ হলো সরীসৃপজাতীয় বুকে ভর দিয়ে চলা একটি প্রাণী। যার শরীরের চামড়া পুরু ও অমসৃণ। তার লেজ চওড়া যা রুক্ষ, খসখসে ও অতি গিটবিশিষ্ট। আরব মরুভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। -আল মুজামুল ওয়াসীত পৃ.৫৩২
আর আমরা যাকে গুইসাপ বলি তা আরবী ورل (ওয়ারাল) নামক প্রাণীর বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে, ضب (দব)এর সাথে নয়। আরবী অভিধানে ‘ওয়ারাল’ এর পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে-
الورل حيوان من الزحفات طويل الأنف والذنب دقيق الخصر، لا عقد في ذنبه كذنب الضب، و هو أطول من الضب أقصر من التمساح، يكون في البر و الماء، يأكل العقارب و الحيات و الحرابي و الخنافس، و العرب تستخبثه و تستقذره فلا تأكله.
ওয়ারাল হল সরীসৃপজাতীয় একটি প্রাণী, যার নাক ও লেজ সুদীর্ঘ। কোমর সরু ও চিকন। দবের লেজের মত তার লেজে কোনো গিট নেই। তার দেহের দৈর্ঘ্য দবের চেয়ে বড়, কুমিরের চেয়ে ছোট। এরা জল ও স্থল উভয়স্থানে চলাচল করে (উভচর প্রাণী)। এরা বিচ্ছু, বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ, সাপ, গিরগিটি, গোবরপোকা ইত্যাদি আহার করে থাকে। আরবরা ওয়ারালকে ঘৃণা করে এবং নিকৃষ্ট মনে করে এবং তা খায় না। -আল মুজামুল ওয়াসীত পৃ.১০২৭
আরবী বিভিন্ন অভিধানে ‘দব’ এবং ‘ওয়ারাল’ দুটো প্রাণীরই ছবি দেয়া আছে। তা দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ‘দব’ এবং ‘ওয়ারাল’ দুটো আলাদা প্রাণী। এছাড়া এ দুই প্রাণীর পরিচয় থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দুটো ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী।
আরবী ভাষার সুপ্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য অভিধান ‘লিসানুল আরব’-এ আল্লামা ইবনে মানযুর রহ. বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন-
(ضب) الضب دويبة من الحشرات معروف وهو يشبه الورل ... قال أبو منصور : الورل سبط الخلق طويل الذنب كان ذنبه ذنب حية ورب ورل يربي طوله على ذراعين، وذنب الضب ذو عقد وأطوله يكون قدر شبر والعرب تستخبث الورل وتستقذره ولا تأكله. وأما الضب فإنهم يحرصون على صيده وأكله.
দব একটি ছোট প্রাণী, যা দেখতে ওয়ারালের মত। ... আবু মানসূর বলেন, ওয়ারাল হল সুগঠিত দেহের অধিকারী একটি প্রাণী। তার লেজ লম্বা; দেখতে সাপের লেজের মত। কোনো কোনো ওয়ারাল দুই হাতেরও বেশি লম্বা হয়। আর দবের লেজ গিটবিশিষ্ট এবং তা সর্বোচ্চ এক বিঘত লম্বা হয়। আরবরা ওয়ারালকে ঘৃণা করে ও নিকৃষ্ট মনে করে। ফলে তা খায় না। আর দব শিকার করতে ও খেতে পছন্দ করে। (দ্র. লিসানুল আরাব, খ.৮ পৃ.৮ মাদ্দা: ضبب)
আরো দেখুন- তাজুল আরূস খ.১ পৃ.৩৪৩ (فصل الضاد،باب الباء), হায়াতুল হায়াওয়ান খ.২ পৃ. ৬৩৬।
আরবী অভিধানের পাশাপাশি হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থের ভাষ্যমতেও ‘দব’ ও ‘ওয়ারাল’ দুটি ভিন্ন প্রাণী।
সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন-
قوله "باب الضب" هو دويبة تشبه الجرجون، لكنه أكبر من الجرجون، ...، و يقال للأنثى ضبة،....و يقال لأصل ذكر الضب فرعين، و لهذا يقال له ذكران.
و ذكر ابن خالويه أن الضب يعيش سبعمائة سنة، و أنه لا يشرب الماء، و يبول في كل أربعين يوما قطرة، و لا يسقط له سن، و يقال بل أسنانه قطعة واحدة، و حكى غيره أن أكل لحمه يذهب العطش، و من الأمثال "لا أفعل كذا حتى يرد الضب" يقوله من أراد أن لا يفعل الشيء، لأن الضب لا يرد بل يكتفي بالنسيم و برد الهواء، و لا يخرج من جحره في الشتاء. (راجع فتح الباري جـ ٩ صـ ٥٨٠)
হাদীসের বিখ্যাতব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোতেও একই বর্ণনা পাওয়া যায়। দেখুন-উমদাতুল কারী; হাশিয়াতুস সিন্দী আলা সহীহিল বুখারী; তুহফাতুল আহওয়াযী; আওনুল মাবুদ (‘দব’’ অধ্যায়)
এদের আদি নিবাস আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য । এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মোটা ও শক্তিশালী লেজ, যা কাঁটার মতো খাঁজযুক্ত এবং আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
وذكر ابن خالويه أن الضب يعيش سبعمائة سنة ، وأنه لا يشرب الماء ويبول في كل أربعين يوما قطرة ولا يسقط له سن ، ويقال بل أسنانه قطعة واحدة
এটি ৭০০ বছর বেঁচে থাকে। সে কখনো পানি পান করে না। ৪০ দিনে একফোঁটা প্রসাব করে। তার দাঁত কখনো পড়ে না।
সান্ডা খাওয়া নিয়ে নবী করিম (সা.) এর হাদীস?
নবী করিম (সা.)-এর সামনে একবার তার সাহাবীরা সান্ডা পরিবেশন করে। তখন তিনি সেটি খাননি। সে সময় তার সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি এটি খেতে অপছন্দ করেন, এটি হারাম?’
এই প্রশ্নের উত্তরে নবী করিম (সা.) বললেন- ‘এটি আমার কওমের খাদ্য নয়, তাই আমি খাই না।’
(সহীহ বুখারী: ৫৫৩৭, সহীহ মুসলিম: ১৯৪৪)
অর্থাৎ, এটি তিনি নিজে না খেলেও সাহাবীদের খেতে মানা করেননি। এমনকি সাহাবীরা তার সামনে এটি খেয়েছেন।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) যাকে ‘সাইফুল্লাহ্’ বলা হতো তার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে মাইমূনাহ (রাঃ)-এর গৃহে প্রবেশ করলেন। মাইমূনাহ (তার ও ইবনু ‘আব্বাসের খালা ছিলেন। তিনি তার কাছে একটি ভুনা দাব্ব দেখতে পেলেন, যা নজদ থেকে তার (মাইমূনাহর) বোন হুফাইদা বিন্ত হারিস নিয়ে এসেছিলেন। মাইমূনাহ (রাঃ) দাব্বটি রাসূলুল্লাহ স.-এর সামনে হাজির করলেন। রাসুলের অভ্যাস ছিল, কোনো খাদ্যের নাম ও তার বর্ণনা বলে না দেয়া পর্যন্ত তিনি খুব কমই তার প্রতি হাত বাড়াতেন।
তিনি দাব্বের দিকে হাত বাড়ালে উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে একজন বললেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ স.-এর সামনে যা পেশ করছ সে সম্বন্ধে তাকে অবহিত কর। বলা হল- হে আল্লাহর রাসূল! ওটা দাব্ব। এ কথা শুনে রাসূল স. তার হাত উঠিয়ে নিলেন। খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দাব্ব খাওয়া কি হারাম? তিনি বললেন, না। কিন্তু যেহেতু এটি আমাদের এলাকায় নেই। তাই এটি খাওয়া আমি পছন্দ করি না। খালিদ (রাঃ) বলেন, আমি সেটি টেনে নিয়ে খেতে থাকলাম। আর রাসূল স. আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। [৫৪০০, ৫৫৩৭; মুসলিম ৩৪/৭, হাঃ ১৯৪৫, ১৭৪৬, আহমাদ ১৬৮১৫] (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৯৯০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮৮৬)
এই হাদিস থেকে বুঝা যায়, নবী সা. নিজে দাব্ব খাননি।
عن ابن عمر أن النبي صلى الله عليه وسلم سئل عن أكل الضب، فقال : لا آكله ولا أحرمه....قال أبو عيسى هذا حديث حسن صحيح، و قد اختلف أهل العلم في أكل الضب، فرخص فيه بعض أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه و سلم و غيرهم، و كرهه بعضهم . و يروى عن ابن عباس أنه قال: أُكِل الضب على مائدة رسول الله صلى الله عليه و سلم، و إنما تركه رسول الله صلى الله عليه و سلم تقذرا.
অর্থ : আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘দব’ খাওয়া না খাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, আমি নিজে তা খাই না তবে তা খাওয়া হারামও বলি না ...। ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, ...আহলে ইলমের মাঝে ‘দব’ খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেক আহলে ইলম সাহাবী ও পরবর্তী ফকীহগণ তা খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। অনেকে তা খাওয়া মাকরূহ বলেছেন। আর হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দস্তরখানে ‘দব’ খাওয়া হয়েছে। তিনি ঘৃণার কারণে তা খাননি।
ফিকহবিদদের মতামত:
ফিকহবিদগণ এই সকল হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন মাজহাবে সান্ডা খাওয়ার হুকুম নির্ধারণ করেছেন।
হানাফি মাজহাব:
ইসলামি আইনবিশারদগণ সান্ডা খাওয়ার বিধানের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। হানাফি ফকিহদের মতে সান্ডা খাওয়া হারাম। কারণ এটা তাদের দৃষ্টিতে খাবাইস বা নাপাক ও অরুচিকর প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। যেসব হাদিসে সান্ডা খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলোকে তারা ইসলামের শুরুর সময়ের ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন—অর্থাৎ, সেই সময়ের, যখন কোরআনের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়নি,
وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ
আর তিনি তাদের জন্য অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেছেন। (সুরা আ'রাফ: ১৫৭)
وقال ابن عابدين في حاشيته "رد المحتار": [والدليل عليه أنه صلى الله عليه وآله وسلم "نهى عن أكل كل ذي ناب من السِّبَاع، وكل ذي مخلب من الطير" رواه مسلم وأبو داود وجماعة، والسر فيه أن طبيعة هذه الأشياء مذمومةٌ شرعًا، فيُخشى أن يتولَّد من لحمها شيءٌ من طباعها، فيحرم إكرامًا لبني آدم، كما أنه يحل ما أحل إكرامًا له، وفي "الكفاية":
# ‘মাছ ব্যতীত জলচর বা উভচর সরীসৃপ যেমন: কচ্ছপ, গুইসাপ, সাপ এবং দব—এগুলো খাওয়া হানাফি মাজহাবে হারাম।’ (আল-হিদায়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৫৭)
#‘শুধু সামুদ্রিক মাছ হালাল; জলজ ও স্থলজ মিলিত প্রাণী, যেমন দব (Spiny-tailed Lizard), গুইসাপ ইত্যাদি খাওয়া হারাম।’ (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৯০)
#‘দব প্রাণীটি সরীসৃপ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, আর হানাফি মাজহাবে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী খাওয়া হারাম হিসেবে গণ্য করা হয়।’ (আল-মাবসুত, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৩১)
#‘প্রকৃতিগতভাবে অপবিত্র বা অরুচিকর সকল প্রাণী হারাম, যেমন: সাপ, গুইসাপ, দব ইত্যাদি।’ (বাদায়েউস সানায়ে, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৮০)
#আয়েম্মায়ে সালাসার বক্তব্য:#
শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি মাজহাব:
এই সব মাজহাবের আলেমদের মতে, সান্ডা খাওয়া পুরোপুরি হালাল।
তারা উপরোক্ত হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
#সান্ডা খাওয়ার চিকিৎসাগত দিক:
বিশ্বের বহু দেশে সান্ডার তেলের চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এবং যৌন শক্তি বৃদ্ধির উপাদান হিসেবে এর তেল ব্যবহার করা হয়। যদিও বর্তমান আধুনিক চিকিৎসায় এটির কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে